কম্পিউটার স্ক্রিনের ক্ষতিকর নীল আলো থেকে চোখকে বাঁচান ।
আমাদের এখন প্রত্যেকেরই আছে একটা করে স্মার্ট ডিভাইজ। হতে পারে সেটা ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপ। অথবা একটা স্মার্টফোন হয়তো। যে যেই ডিভাইজই ব্যবহার করি না কেনো, সকলেরই জানার কথা, এখন সকল স্ক্রিনই এলইডি। এলইডি স্ক্রিন যেমন প্রতিটি ছবিকে করে তোলে জীবন্ত তেমনই এটা আমাদের চোখেরও সাধন করছে ভয়ানক ক্ষতি যা আমাদের অন্ধত্বের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।
কারণ এই নীল আলোর তরঙ্গ দৌর্ঘ অনেকটাই ইউভি রশ্মির মতো যাকে আমরা সুর্যের অতিবেগুনী রশ্মি হিসেবে চিনতে পারি। তাই রাতের বেলায় এই নীল আলো চোখে পড়লে মস্তিস্ক রাতের বেলাতেও দিনের বেলা মনে করে এবং ঘুম চক্র নষ্ট করে ফেলে।
আমাদের ব্যবহার করা সকল প্রকার আলোতেই রয়েছে এই নীল আলোর অস্তিত্ব। সিএফএল বা এনার্জি সেভিং ল্যাম্পে রয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ নীল আলোর উপস্থিতি। এলইডি বাতিতে রয়েছে ৩৫ শতাংশ। স্মার্টফোন, ট্যাবের মতো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিয়মিত ব্যবহারের অভ্যাস হয়ে গেলে ঘুম এবং স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।
রাতে কম্পিউটারে কাজ করলে বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে ঘুম নষ্ট হয়ে যায়, এ কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিন কেন ঘুম নষ্ট করার জন্য দায়ী? এলইডি স্ক্রিন থেকে নির্গত কৃত্রিম নীল আলো ঘুমের চক্র নষ্ট করে দেয় এবং স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মেলাটোনিন হচ্ছে দেহে ঘুম আনার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন। এ ছাড়া ক্যানসারের মতো রোগের বিস্তারে প্রতিরোধ গড়ে তোলে মেলাটোনিন। গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন যে শরীরে মেলাটোনিন নামক উৎসেচকের উত্পাদন প্রক্রিয়ায় এলইডি স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো এই ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে।
আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির এক ভিডিও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, নীল আলো আমাদের শরীরে এমন প্রভাব ফেলে যাতে শরীর রাতের বেলাতেও ধারণা করে নেয় সকাল হয়ে গেছে। তারা নিদ্রাহীনতার জন্য রাতের বেলা ডিজিটাল ডিভাইজের অতিরিক্ত ব্যবহারকে দায়ী করেন।
ঘুম চক্র পরিবর্তন করার পাশাপাশি রাতের বেলা মোবাইল বা অন্যান্য যন্ত্রের ব্যবহারে আরও বেশ কিছু ক্ষতি হতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে চোখের সমস্যা। চোখের ক্ষতির জন্যও দায়ী করা যেতে পারে রাতের বেলা অতিরিক্ত সময় মোবাইলের ব্যবহার। চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, রেটিনার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাতে চোখের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মেলাটোনিনের ঘাটতিতে স্তন, গর্ভাশয় ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি হয়। গবেষকেরা দাবি করেছেন, নীল আলোর সামনে বেশি সময় থাকার ফলে মেজাজের ওপর প্রভাব পড়তে দেখা যায়। ইঁদুরের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মেলাটোনিনের মাত্রা কম হয়ে গেলে বিষণ্নতার মাত্রা বেড়ে যায়। মন ভালো থাকে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেলাটোনিনের ঘাটতিতে এ ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব কেনো হয়? গবেষকেরা বলছেন, মেলাটোনিন যেহেতু ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাদের হৃপিন্ডের ছন্দের ওপর এর প্রভাব রয়েছে। হৃদযন্ত্রের ছন্দের পরিবর্তন দেখা দিলে তা শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ তৈরি করে। হৃদযন্ত্রের এই ছন্দ হচ্ছে দেহের অভ্যন্তরীণ জৈবিক ঘড়ি যা রাতের ঘুম আর দিনে জেগে থাকার বিষয়টি অনুভব করায়।
দেহঘড়ির ওপর প্রভাবের এই বিষয়টি অন্য গবেষণাও দেখা গেছে। এর আগে ২০১২ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষকেরা তাঁদের পরীক্ষায় দেখেছিলেন যে, রাতের বেলা জেগে কাজ করলে হৃদযন্ত্রের ছন্দে পরিবর্তন দেখা যায়।
যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টি দেখা দিতে পারে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে তা ব্যবহার করেন। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার। সংবাদপত্র, বই বা কোনো কিছু পড়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চোখ থেকে গগে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্ব থাকে। চোখের খুব কাছে রেখে অতিরিক্ত সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্ষীণদৃষ্টি সৃষ্টির জন্য যা ভূমিকা রাখতে সক্ষম। গবেষকেরা একে ‘এপিজেনেটিকস’-সংক্রান্ত বিষয় বলেন।
এই নীল আলো থেকে আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে চাইলে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি:
আমরা আমাদের মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনের জন্য ব্লু লাইট ফিল্টার করার অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করতে পারি। এছাড়া আমাদের অনেকের মনিটরে বিল্ট ইন নাইট মোড থাকে, সেটা আমরা ব্যবহার করতে পারি। এছাড়া উইন্ডোজ টেনের সর্বশেষ আপডেটে নাইট মোড দেয়া হয়েছে, আমরা সেটাও ব্যবহার করতে পারি।
আমরা আমাদের ঘরের আলো পরিবর্তন করে ফেলতে পারি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে কালার টেম্পারেচার বা আলোর তাপমাত্রা মেপে আলোর উৎস নির্ধারন করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ২৪০০কে বা কেলভিনের নিচে আলো নির্ধারন করতে হবে। ৬৪০০কে এর বাল্ব বা আলোর উৎসগুলো হবে একেবারে সাদা যাতে নীলের পরিমাণ বেশি। এবং এই কেলভিন রেটিং যত কমবে, আলোর তাপমাত্রা বাড়বে, অর্থাৎ হলদে হবে এবং নীল আলোর পরিমাণ কমে যাবে। তাই আমরা ঘরে হলদে আলো ব্যবহার করতে পারি।
Post a Comment